মিশমিশে কালো অন্ধকার ভেদ করে পিচকালো রাস্তা দুধারের বিশাল বিশাল গাছের হেলে পড়া ডালের সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে । হেডলাইটের আলো যতটা দূরত্বে গাছের গায়ে ধাক্কা লেগে আলোকিত হচ্ছে, ততটুকুই যেন জগত, এছাড়া বিশ্বসংসারে আর কোথাও কিছুর অস্তিত্ব নেই । বেশ কয়েকবছর আগের কথা, শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা ফিরছি , রাত প্রায় দেড়টা, নির্মীয়মাণ জাতীয়সড়ক এনএইচ ৩৪ তখনও ভারী ট্রাক চলায় ধুলোর আস্তরণে প্রায় কুয়াশাচ্ছন্ন । সামনের একটা বাইকে দুই ভাতৃপ্রতিম বন্ধু , আমার দীর্ঘদিনের রাইডিং পার্টনার । ওই বাইকে জোরালো এইচআইডি লাইট লাগানো, পেছনে আমি আমার বাইকে একা । এভাবে চলতে চলতে কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না, দুর্গোৎসবের শেষে দ্বাদশীর চাঁদও ক্লান্ত হয়ে অস্তাচলগামী। রাস্তাঘাট শুনশান, শুধু মাঝে মধ্যে কয়েকটা শেয়াল দৌড়ে রাস্তার এপার ওপার করছে । আর মাঝে মধ্যে মানুষের আনাগোনা, রাস্তা পারাপার । তবে হেডলাইটের আলোয়, আর বাইকের গতিতে মানুষের অবয়বগুলিই বোঝা যাচ্ছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না । গ্রামের মানুষ হবে হয়ত, অথবা চোর ছ্যাঁচড় । খেয়াল করলাম, শরতের রাতে হালকা ঠান্ডায় সবাই চাদর পড়ে আছে । এখানে থামার কোন প্রশ্নই নেই, বাইকের গতি একটু বাড়ালাম । কিন্তু সেই অবয়বগুলোর আনাগোনা যেন বেড়ে গেল । আর তাদের রাস্তা পার হওয়াটাও যেন বিচিত্র , পায়ে যেন চাকা লাগানো, নিয়ন্ত্রিত গতিতে ভ্রূক্ষেপহীন হয়ে রাস্তা পার হচ্ছে ।
বাইক চালালে একজন বাইকারকে সামনে ও পেছনে একইসাথে নজর রেখে চলতে হয়, পর্যায়ক্রমে সামনের দিকে আর পেছনের আয়নায় ক্রমাগত লক্ষ্য রাখতে হয় আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস পেতে । এটা অভ্যাসে পরিণত করতে হয় । আমিও সেভাবেই তাকাচ্ছিলাম । কিন্তু মনে কেমন যেন অস্থিরতার উন্মেষ ঘটল, ভাস্করের বাইক অনেকক্ষণ ধরেই দেখতে পাচ্ছি না , অথচ শুনশান রাস্তায় আমি তখন যেন একা নই । আমার পাশে পাশে যেন কেউ চলছে । রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম একাধিক বাইকের আলো । তিন চারটে বাইক হঠাত কোথা থেকে এলো রে বাবা ! ডাকাত নয়তো ? বেশ চিন্তায় পড়লাম, কিন্তু বাইক গুলো আমাকে ওভারটেক করছে না । ভাবলুম স্থানীয় মানুষ হবে , একটু ভালো করে দেখব বলে পেছনে তাকাতেই প্রথম চমকটা পেলাম । কেউ কোথাও নেই, সঙ্গে সঙ্গে আবার রেয়ার ভিউ মিররে তাকালাম । নাহ ! আশ্চর্য , পেছনের বাইকগুলো কোথায় গেল কে জানে ? কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার বাইকের আলো দেখা গেল , আবার যথারীতি পেছনে তাকাতে দেখলাম কেউ নেই । অথচ , বেশ মনে হচ্ছে যেন আমার পাশে পাশে আরও কয়েকটা বাইক চলছে । এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর আবার রেয়ার ভিউ মিররে আলোগুলো দেখলাম । আর সাথে সাথে একটা লরির হর্ন বাজল । রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম জোরাল আলো, একটা লরি পেছন থেকে বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে আসছে । তার সামনে ওই বাইকগুলো, আর আমি তাদের থেকে একটু এগিয়ে । পেছনে তাকাবার সময় নেই, লরিটা কাছাকাছি এসে পড়েছে । ঠিক করলাম, এসময় সামনের কোন escape খুঁজে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লরির গতিবেগের ওপর নজর রাখব । বাকিটা ঈশ্বরের ইচ্ছে । এমন সময় দেখলাম বাইকগুলো আমাকে ওভারটেক করে অসম্ভব জোরে এগিয়ে গেল , রাস্তাটা ডানদিকে মোড় নিয়েছে , পেছনে লরি , এই সুযোগ, আমি রাস্তা ছেড়ে নিচে নেমে গেলাম । লরিটা একদম গা ঘেঁসে যেন বাইকগুলোকে তাড়া করতে করতে চলে গেল । পথের ধারের সুরকি পথে চাকা একটু স্কিড করল , টাল সামলে বাইক থামালাম ।
বাইক থামতে যেন অন্য জগতে ফিরে এলাম । লরির শব্দ শোনা যাচ্ছে না, বদলে শুধুই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক । নিশুতিরাত, জনমানব শূন্য রাস্তা, চাঁদটা আরও ঢলে পড়েছে । সামনে বন্ধুর বাইকও দেখা যাচ্ছে না । ফোনের চার্জও শেষ অনেকক্ষণ । তাই দেরী না করে আবার এগোতে থাকলাম । রাস্তাটা ডানদিকে ঘুরেছে, একটু এগিয়েই হেডলাইটের আলোয় আরও কিছু লোকজন, আমাকে দেখেই দ্রুত এগিয়ে এলো । বাইকের গতি কমাতেই এরমধ্যে একজন বললেন, “ দাদা, একটু এগিয়ে দিন, সামনেই একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে ।” এই বলেই আমার পেছনের সিটে বসে পড়লেন । বেশ ভয় লাগছিল, ডাকাতের পাল্লায় পড়লাম না তো ?! তবুও, উপায় নেই । কিছুটা এগিয়েই বাইকটা থামাতে বললেন ভদ্রলোক । সামনে রাস্তার ধারে একটা কিছু ঘিরে আরও কিছু লোকের জটলা ।
লোকটি আমার বাইকের পেছন থেকে নেমে গেলেন । আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন মনে হয়, আমার কানে কিছুই ঢুকল না, আমি পাশ কাটিয়ে গতি বাড়ালাম । কিছুটা যেতেই সামনে পেছনে আবার সেই নিকশ কালো অন্ধকার । বেশ দিশেহারা মনে হচ্ছিল নিজেকে । এমন সময় রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম পেছনে হঠাত আলোর ঝলকানির মত সাদা HID লাইট। ভাস্করের বাইক না ? গতি কমাতেই সত্যি সত্যিই ভাস্কর আর অয়ন এসে পড়ল । “ কি গো জয়দীপদা ? হঠাত স্পিড বাড়িয়ে এগিয়ে গেলে কেন ?! ”
“ আসলে, অন্ধকারে মনে হয় একটু তন্দ্রা এসেছিল, খেয়াল করিনি । আচ্ছা, তোদের কি কোন লরি ওভারটেক করেছিল একটু আগে ? রাস্তায় কোন গোলমাল দেখলি ? ”
“ কৈ ? নাতো ? তুমি ঠিক আছো তো ? ”
“ দিব্য আছি । বেঁচে আছি । অয়ন, তুই বাকি রাস্তা আমার বাইকটা চালা , আমি পেছনের সিটে বসছি, লাগেজটা ভাস্কির বাইকের পেছনে বেঁধে দে । ”
চাঁদটা তখন পশ্চিমে অস্তগামী । সহযাত্রীর সাথে আবার একত্র হতে পেরে বেশ রিল্যাক্সড লাগছে । এখানে রাস্তাটা বেশ খোলামেলা , ওইরকম গাছের সুড়ঙ্গ নেই । আমার যুক্তিবাদী মন বলছে , “ অল ইজ ওয়েল । হয়ত ঘুমের ঘোরে হ্যালুসিনেশান হয়েছে । হয়ত আমি অন্য কোন ঘুরপথে ঢুকে পড়েছিলাম যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে, যেটায় ভাস্করেরা যায়নি । রাস্তাটা আবার একজায়গায় মিশেছে , তাই দেখা হয়ে গেছে । শুধু একটাই হিসাব মিলল না । আমার পেছনের সিটে আমার লাগেজ বাঁধা ছিল, সেখানে কোন মানুষের পক্ষেই বসা সম্ভব নয় ।
( ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত )
বাইক চালালে একজন বাইকারকে সামনে ও পেছনে একইসাথে নজর রেখে চলতে হয়, পর্যায়ক্রমে সামনের দিকে আর পেছনের আয়নায় ক্রমাগত লক্ষ্য রাখতে হয় আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস পেতে । এটা অভ্যাসে পরিণত করতে হয় । আমিও সেভাবেই তাকাচ্ছিলাম । কিন্তু মনে কেমন যেন অস্থিরতার উন্মেষ ঘটল, ভাস্করের বাইক অনেকক্ষণ ধরেই দেখতে পাচ্ছি না , অথচ শুনশান রাস্তায় আমি তখন যেন একা নই । আমার পাশে পাশে যেন কেউ চলছে । রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম একাধিক বাইকের আলো । তিন চারটে বাইক হঠাত কোথা থেকে এলো রে বাবা ! ডাকাত নয়তো ? বেশ চিন্তায় পড়লাম, কিন্তু বাইক গুলো আমাকে ওভারটেক করছে না । ভাবলুম স্থানীয় মানুষ হবে , একটু ভালো করে দেখব বলে পেছনে তাকাতেই প্রথম চমকটা পেলাম । কেউ কোথাও নেই, সঙ্গে সঙ্গে আবার রেয়ার ভিউ মিররে তাকালাম । নাহ ! আশ্চর্য , পেছনের বাইকগুলো কোথায় গেল কে জানে ? কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার বাইকের আলো দেখা গেল , আবার যথারীতি পেছনে তাকাতে দেখলাম কেউ নেই । অথচ , বেশ মনে হচ্ছে যেন আমার পাশে পাশে আরও কয়েকটা বাইক চলছে । এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর আবার রেয়ার ভিউ মিররে আলোগুলো দেখলাম । আর সাথে সাথে একটা লরির হর্ন বাজল । রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম জোরাল আলো, একটা লরি পেছন থেকে বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে আসছে । তার সামনে ওই বাইকগুলো, আর আমি তাদের থেকে একটু এগিয়ে । পেছনে তাকাবার সময় নেই, লরিটা কাছাকাছি এসে পড়েছে । ঠিক করলাম, এসময় সামনের কোন escape খুঁজে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লরির গতিবেগের ওপর নজর রাখব । বাকিটা ঈশ্বরের ইচ্ছে । এমন সময় দেখলাম বাইকগুলো আমাকে ওভারটেক করে অসম্ভব জোরে এগিয়ে গেল , রাস্তাটা ডানদিকে মোড় নিয়েছে , পেছনে লরি , এই সুযোগ, আমি রাস্তা ছেড়ে নিচে নেমে গেলাম । লরিটা একদম গা ঘেঁসে যেন বাইকগুলোকে তাড়া করতে করতে চলে গেল । পথের ধারের সুরকি পথে চাকা একটু স্কিড করল , টাল সামলে বাইক থামালাম ।
বাইক থামতে যেন অন্য জগতে ফিরে এলাম । লরির শব্দ শোনা যাচ্ছে না, বদলে শুধুই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক । নিশুতিরাত, জনমানব শূন্য রাস্তা, চাঁদটা আরও ঢলে পড়েছে । সামনে বন্ধুর বাইকও দেখা যাচ্ছে না । ফোনের চার্জও শেষ অনেকক্ষণ । তাই দেরী না করে আবার এগোতে থাকলাম । রাস্তাটা ডানদিকে ঘুরেছে, একটু এগিয়েই হেডলাইটের আলোয় আরও কিছু লোকজন, আমাকে দেখেই দ্রুত এগিয়ে এলো । বাইকের গতি কমাতেই এরমধ্যে একজন বললেন, “ দাদা, একটু এগিয়ে দিন, সামনেই একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে ।” এই বলেই আমার পেছনের সিটে বসে পড়লেন । বেশ ভয় লাগছিল, ডাকাতের পাল্লায় পড়লাম না তো ?! তবুও, উপায় নেই । কিছুটা এগিয়েই বাইকটা থামাতে বললেন ভদ্রলোক । সামনে রাস্তার ধারে একটা কিছু ঘিরে আরও কিছু লোকের জটলা ।
লোকটি আমার বাইকের পেছন থেকে নেমে গেলেন । আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন মনে হয়, আমার কানে কিছুই ঢুকল না, আমি পাশ কাটিয়ে গতি বাড়ালাম । কিছুটা যেতেই সামনে পেছনে আবার সেই নিকশ কালো অন্ধকার । বেশ দিশেহারা মনে হচ্ছিল নিজেকে । এমন সময় রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম পেছনে হঠাত আলোর ঝলকানির মত সাদা HID লাইট। ভাস্করের বাইক না ? গতি কমাতেই সত্যি সত্যিই ভাস্কর আর অয়ন এসে পড়ল । “ কি গো জয়দীপদা ? হঠাত স্পিড বাড়িয়ে এগিয়ে গেলে কেন ?! ”
“ আসলে, অন্ধকারে মনে হয় একটু তন্দ্রা এসেছিল, খেয়াল করিনি । আচ্ছা, তোদের কি কোন লরি ওভারটেক করেছিল একটু আগে ? রাস্তায় কোন গোলমাল দেখলি ? ”
“ কৈ ? নাতো ? তুমি ঠিক আছো তো ? ”
“ দিব্য আছি । বেঁচে আছি । অয়ন, তুই বাকি রাস্তা আমার বাইকটা চালা , আমি পেছনের সিটে বসছি, লাগেজটা ভাস্কির বাইকের পেছনে বেঁধে দে । ”
চাঁদটা তখন পশ্চিমে অস্তগামী । সহযাত্রীর সাথে আবার একত্র হতে পেরে বেশ রিল্যাক্সড লাগছে । এখানে রাস্তাটা বেশ খোলামেলা , ওইরকম গাছের সুড়ঙ্গ নেই । আমার যুক্তিবাদী মন বলছে , “ অল ইজ ওয়েল । হয়ত ঘুমের ঘোরে হ্যালুসিনেশান হয়েছে । হয়ত আমি অন্য কোন ঘুরপথে ঢুকে পড়েছিলাম যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে, যেটায় ভাস্করেরা যায়নি । রাস্তাটা আবার একজায়গায় মিশেছে , তাই দেখা হয়ে গেছে । শুধু একটাই হিসাব মিলল না । আমার পেছনের সিটে আমার লাগেজ বাঁধা ছিল, সেখানে কোন মানুষের পক্ষেই বসা সম্ভব নয় ।
( ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত )
Wahh! besh sundor.kintu rahoshyer gondho ta ektu kom.
ReplyDelete