Saturday, 16 March 2019

তৃষিত তিয়াস


পাহাড়ের কোলে সন্ধ্যা নেমে আসছে দ্রুত । আজ শনিবার, সৌম্যর আজ হাফছুটি । অফিসের কাজ সেরে উইকেএন্ডের ছুটি কাটাতে যাবে বলে যখন শিলিগুড়ির বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছল, তখন একটাই বাস দাঁড়িয়ে, আজকের মত গ্যাংটক যাওয়ার শেষ বাস। পূর্বনির্ধারিত কোন গন্তব্য স্থির না থাকায় অগত্যা ওটাতেই সে সওয়ার হল । ছোট্ট বাস, সৌম্য বাদে বাকি সকলেই স্থানীয় লোক  । বাস বেশ ভালোই চলছিল, মাঝে মাঝে দুয়েক জায়গায় লোকজনের ওঠানামা । কিন্তু বিধি বাম । যান্ত্রিক গোলযোগে বাস সিংতামে এসেই দাঁড়িয়ে গেল ।





মেঘলা গোধূলিবেলা, ধীরে ধীরে নিঝুম কালো অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ছোট্ট জনপদ ।ছোট্ট শহর সিংতাম, দোকানপাট এরমধ্যেই বন্ধ হতে শুরু করেছে । তবে পাহাড়ি শহর হলেও একটু গুমোটে ভাব । বাড়ি ঘরের জানালা দিয়ে পাখাও চলতে দেখা যাচ্ছে । রাস্তায় জনমানুষ তেমন নেই । এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাকল, " ও গ্যাংটক যানেওয়ালে ভাইসাব " । এমন সম্বোধনে হকচকিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক । পেছনে তাকিয়ে সৌম্য দেখল বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারার একজন স্থানীয় মানুষ । দুহাতে দুটো টিনে সম্ভবত রান্নার তেল । আর কাঁধে এক ঝোলায় খুব সম্ভবত নানা রকমের মশলাপাতি । রাস্তার টিমটিমে আলোয় মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, তবে মুখে যে একটা মিষ্টি হাসি আছে - সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে । থাকেন রাবংলা, সৌম্যর সাথে ওই বাসেই ছিলেন। সিংতামে এসে বাস পাল্টে তিনি বাড়ি ফিরবেন । ইতিমধ্যেই একটা জিপ ভাড়া করেছেন, সেই গাড়িতে যদি আজ রাতেই রাবংলা যাওয়া যায়, তাহলে গাড়িভাড়াটা শেয়ার করে যাওয়া যেতে পারে । উত্তম প্রস্তাব , নামী কোম্পানির টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার সৌম্য, বছর ছাব্বিশের অবিবাহিত যুবক, চাকরি সুত্রে শিলিগুড়ি আসা, পিছুটান নেই, তাই কোথাও একটা গেলেই হল। গ্যাংটকে তো বহুবার যাওয়া হয়েছে । রাবংলার দিকটায় যাওয়া হয়নি । 




পাহাড়ের পথে জিপ চলতে শুরু করল, শহর ছাড়িয়ে একটু এগোতেই একরাশ নিকশ কালো অন্ধকারের গ্রাসে ঢেকে গেল চারিদিক, গাড়ির জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না, গাড়ির ভেতরেও আরও জমাট অন্ধকার। হেডলাইটের আলোয় শুধু সামনের দিকের রাস্তাটুকু দেখা যাচ্ছে । গাড়ি যে কোন পথে কোথায় যাচ্ছে, তা ঠাওর করা যাচ্ছে না । ভেতরে কিন্তু আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। লোকটির নাম পাষাং , রাবংলাতে একটি হোম স্টে চালান। বেশ আমুদে ভদ্রলোক, নানান মজার সব কথা বলতে লাগলেন। বাড়িতে স্ত্রী আছেন, আজকে বিবাহবার্ষিকী । তাই বিশেষ উপহার নিয়ে যাচ্ছেন স্ত্রীর জন্য। কথায় কথায় বিয়ার বের করলেন ঝোলা থেকে। আজ বিবাহবার্ষিকী, তাই এখন থেকেই সেলিব্রেশন। বিয়ার খেতে খেতে নানান কথা হচ্ছিল । এভাবে এক অচেনা মানুষ এত তাড়াতাড়ি এতো কাছের বন্ধু হয়ে যাবে, সৌম্যর তা ধারণা ছিল না । সৌম্য জিজ্ঞাসা করল , বিবাহবার্ষিকীতে বউ-এর জন্য কী গিফট নিয়ে যাচ্ছে পাষাং ? পাষাং বেশ রসিকতার সুরে বলল, " কেন ? এই তো তোমাকেই নিয়ে যাচ্ছি ।" ইয়ার্কিটা সৌম্যর পছন্দ হল না, তবুও হাসল ।  হাসি ঠাট্টায় কখন যে রাবংলা পৌঁছে গেল, বুঝতেই পারিনি ।যদিও শহরটা রাবংলা না অন্য কোথাও, সেটা বোঝার উপায় নেই ।  গাড়ি থামল মূল শহর থেকে আরও কিছুটা দূরে এক জায়গায়। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিঁঝিঁ পোকার অবিশ্রান্ত ডাক। বেশ ঠান্ডা লাগছে ।



মূল রাস্তা থেকে জঙ্গলে ঢাকা পথে একটু নিচে নেমে পাষাং-এর হোম স্টে । বেশ ঠান্ডা চারিদিক । আশেপাশে আর কোন বাড়ি আছে বলেও মনে হল না । ইলেক্ট্রিসিটি নেই মনে হয়, শুধু ঘরের ভেতর থেকে টিমটিমে একটা আলো দেখা যাচ্ছে । সৌম্য যতই সেই হোম স্টে-র দিকে এগোতে লাগল , ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কমে চারিদিক অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায় ডুবে যেতে লাগল , আর পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল ঠান্ডা । ঘরের লাগোয়া বারান্দায় টিমটিমে একটা কেরোসিন ল্যম্প নিয়ে পাষাং-এর স্ত্রী বেরিয়ে এলেন । পাষাং স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল, " নাও, তোমার জন্য গেস্ট এনেছি । একটু খাতির যত্ন করো ।" পাষাং আর সৌম্যকে দেখে অদ্ভুত এক লাস্যময়ী স্মিতহাস্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল পাষাং-এর স্ত্রীর মুখ । 

দু'কামরার ছোট্ট কাঠের বাড়ি । সামনের ঘরটিতে গেস্ট থাকেন, সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম । পেছনের ঘরে পাষাং-এর সংসার । তোফা বন্দোবস্ত । একটা খাট, খাটের পাশে ড্রেসিং টেবিল । ঘরে একটা টেবিল চেয়ারও রয়েছে । টর্চের আলোয় দেখে নিল সৌম্য, সারাদিন অনেক ধকল গেছে , ঝটপট ব্যগ রেখে ফ্রেশ হবার জন্য জুতো খুলতে লাগল । একটা কেরোসিন ল্যাম্প নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল পাষাং-এর স্ত্রী । এই প্রথম ভালো করে তাকে দেখতে পেল সৌম্য । বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি মারছে কেউ । এত সুন্দরী মহিলা এর আগে সৌম্য দেখেনি । মহিলাও সৌম্যর দিকে লাস্যময়ী দৃষ্টিতে চাইলেন । চোখে অদ্ভুত এক মাদকতা আছে, যে কোন পুরুষকেই বশ করার ক্ষমতা রাখে সেই দৃষ্টি , সারা শরীরে শিহরণ জাগায় । বেশ কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকে সৌম্য নিজেই লজ্জা পেল ।
লাজুক হেসে সৌম্য বলল, " Happy marriage anniversary ভাবি" । প্রত্যুত্তরে হেসে জবাব এলো, "আমার নাম তিয়াস । ফ্রেশ হয়ে নিন, পরে কথা হবে " । এই বলে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে প্রস্থান করলো তিয়াস ।

ভালো করে ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলের পাশে এসে ওপর বসল সৌম্য । একটাই টিমটিমে আলো, পুরো ঘরটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না ।  দরজা ভেজানোই ছিল । পাষাং ভেতরে এসে বললেন , একটা জরুরী কাজে তাকে কাছেই একগ্রামে তার আত্মীয়ের বাড়ি যেতে হবে । যে জিপটা করে তারা এসেছিল, সেটাতেই নাকি তিনি যাবেন । এই বলে তিনি চলে গেলেন । সবই কেমন যেন নিঝুম, কোথাও কোন শব্দ নেই । কিছুক্ষণ বসার পরই একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো সৌম্য । এই নির্জন অন্ধকারে, এরকম একটা অচেনা গ্রামে, এক ভদ্রলোক এভাবে এত রাতে চলে গেলেন, অথচ বাড়িতে একা স্ত্রী আর অচেনা একটা লোক ! কে জানে, হয়ত পাহাড়ি মানুষের সরলতা হবে । পরক্ষণেই আবার মনে দুশ্চিন্তার উদ্রেকও হল - তাকে কোন ভাবে ফাঁসানোর চক্রান্ত রচিত হচ্ছে নাতো ? অন্ধকার ঘরে ল্যাম্পের বিপরীতে নিজের ছায়া দেখে নিজেই কেমন চমকে উঠল সৌম্য । সেই ঘরে সে একা । কয়েকটা পোকা খালি উড়ে এসে ভীড় করছে ল্যাম্পের পাশে । কয়েকটা আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে অজানা এক সম্মোহনে ।  এই নিঃশব্ধতা, এই নিঃসঙ্গতা সবই অদ্ভূত লাগছে তার কাছে, সবই যেন অদৃশ্য এক নিয়তির রহস্যময় অঙ্গুলিলেহনে হচ্ছে । নাহলে চেনা জানা নেই, পাশাং এর সাথেই বা কেন যোগাযোগ হলো, কেনই বা অচেনা সে এক মানুষের সাথে তার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিল ? সম্বিৎ ফিরলো তিয়াসের ডাকে, " ক্যায়া শোচ রহে হো সাব, খানা কা লো " ।
খাবার নিয়ে তিয়াস হাজির । তিয়াসকে আরও মোহময়ী লাগছে । হাউসকোটের ভেতর রাত পোষাকের মধ্যে দেহ বিভঙ্গের রেখা স্পষ্ট , সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল সৌম্যর । খাবার বলতে রুটি আর মাংস । কিন্তু মুখে দিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো । চিকেন মাটন নয়, এমনকি পর্ক কিংবা বিফও না.. যেন অন্যকিছুর মাংস । খেতে পারল না সৌম্য । চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে দেখলো পেছনে তিয়াস তাকিয়ে আছে সৌম্যর দিকে, একদৃষ্টে । চোখে এক অজানা সম্মোহনী আহ্বান । " ক্যায়া হুয়া সাব? খানা পসন্দ নেহি হুয়া? " 
বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো সৌম্যর । কিন্তু মনে মনে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো । 
ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞাসা করলো, " পাষাং সাব কব লউটেঙ্গে ? "
তিয়াস হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলল, " ও তো চলা গ্যায়া, আজ আর ফিরবে না । আভি স্রেফ তুম আউর ম্যায় " !
তিয়াস খুব কাছে এগিয়ে এলো । এরকম পরিস্থিতির জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না সৌম্য । এসব তো নিষিদ্ধ চটি গল্পের বইতে হয় ! ভয় মিশ্রিত ভালোলাগায় মন উচাটন হয়ে উঠল । ন্যায় - অন্যায়ের দ্বন্দ্বে মন তার দিশেহারা । কিন্তু অমোঘ এক আকর্ষণে তার সারা শরীরে উন্মাদনা । তবু মনকে শান্ত করে দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখান করল তিয়াসকে । তিয়াসও কিছুটা হতাশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । তিয়াস বেরিয়ে যেতেই ঘরের দরজা বন্ধ করে লক লাগিয়ে দিল সৌম্য । খাটে শুয়ে পড়ল । কটা বাজে সেও বোঝা যাচ্ছে না । মোবাইলে চার্জ নেই । হাতে ঘড়িও নেই । বেশ ঠান্ডা লাগছে, অথচ সারা শরীর ঘেমে গেছে । ঘুম আসছে না । সুন্দরী রমণীর হাতছানি উপেক্ষা করে কজন পুরুষই বা শান্ত থাকতে পারে ? যত সময় গড়াতে লাগলো , শরীরের কামনা বাড়তে লাগলো , চিন্তায় বারবার তিয়াসকে দেখতে পেল । এভাবে কিছুক্ষণ থাকতে থাকতে তন্দ্রা এলো । 

কিছুটা ঘুমিয়ে পড়েছিল , পাশ ফিরতে গিয়ে নরম শরীরের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল সৌম্য ! ঘরের ল্যাম্পের আলো প্রায় নিভু নিভু, সেই আলোয় দেখল তিয়াস তার পাশেই শুয়ে আছে । তারদিকে তাকিয়ে সেই লাস্যময়ী হাসি , চোখে সর্বগ্রাসী কামনা ! কিভাবে এলো তিয়াস ! সৌম্যর স্পষ্ট মনে আছে, সে নিজে ঘর বন্ধ করে শুয়েছে ! তিয়াস আরও কাছে সরে এলো । পরনে তার শুধুই রাত পোশাক। তিয়াস সৌম্যর গালে হাত দিল । অস্বাভাবিক ঠান্ডা সে হাত । সৌম্য উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু একটা যেন তাকে আটকে রেখেছে । তিয়াস সৌম্যর শরীরের ওপর চেপে বসেছে । সৌম্য চেষ্টা করলেও কিছুই করতে পারছে না । সে যেন তার সমস্ত শক্তি হারিয়েছে । যেন ময়াল সাপ তাকে জড়িয়ে ধরেছে । তিয়াসের ঠোঁট তার সারা মুখের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে । হঠাত খুব জোরে হেসে উঠল তিয়াস । তার এলোচুল ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখের ওপর । মুখটা অদ্ভুত সাদা , আর চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল । তিয়াস ঝুঁকে পড়ে সৌম্যর মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে এলো । হিসহিসে গলায় বলল, " আব মেরী পিয়াস বুঝাও সাব "। এই বলে সজোরে কামড়ে ধরল সৌম্যর গলা । সৌম্যর শরীরের রক্ত শুষে চলেছে তিয়াস । সৌম্যর জ্ঞান আছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছে না । যত সময় যাচ্ছে, এক শীতলতার দিকে ঢলে পড়ছে , মৃত্যুর পথে ঢলে পড়ছে সৌম্য । তবু মরার আগে শেষ চেষ্টা করল । খাটের পাশে ড্রেসিংটেবিলের ওপর তার ছুড়িটা ছিল । সৌখিন হলেও কাজের, ছুড়ির হাতলে তিব্বতী মন্ত্র খোদাই করা । সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়িটা হাতে নিয়ে চালাল তিয়াসের গলা লক্ষ্য করে । হকচকিয়ে গিয়ে তিয়াস সৌম্যকে ছেড়ে খাট থেকে নেমে পড়ে । সৌম্য টর্চের জোরালো আলো ফেলে তিয়াসের মুখে । তিয়াস হঠাত মিলিয়ে যায় , যাওয়ার খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে আগে বলে যায়," ফির মিলেঙ্গে সাব , অব তো তুম হাম জ্যায়সা বন গয়ে হো "। সৌম্য অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলো  ।


সৌম্যকে পরদিন উদ্ধার করা হয় রাস্তার ধারের জঙ্গল থেকে । সৌম্যর অচৈতন্য দেহের আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর পাওয়া যায়নি । পাষাং নামের কোন ব্যক্তি বা হোম স্টেও ছিল না সেখানে । গলার গভীর ক্ষত থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল সৌম্যর । হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর সৌম্য যা বলেছিল , তা কেউ বিশ্বাস করেনি ।  এরপর থেকে সৌম্যর আচরণে , খাদ্যাভ্যাসে বেশ পরিবর্তন এসেছিল । কিছুদিন পর সৌম্য রাবংলার উদ্দেশে আবার রওনা হয় । এরপর আর কোনোদিনও সৌম্যকে খুঁজে পাওয়া যায়নি ।  


1 comment: