Saturday, 16 March 2019

তৃষিত তিয়াস


পাহাড়ের কোলে সন্ধ্যা নেমে আসছে দ্রুত । আজ শনিবার, সৌম্যর আজ হাফছুটি । অফিসের কাজ সেরে উইকেএন্ডের ছুটি কাটাতে যাবে বলে যখন শিলিগুড়ির বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছল, তখন একটাই বাস দাঁড়িয়ে, আজকের মত গ্যাংটক যাওয়ার শেষ বাস। পূর্বনির্ধারিত কোন গন্তব্য স্থির না থাকায় অগত্যা ওটাতেই সে সওয়ার হল । ছোট্ট বাস, সৌম্য বাদে বাকি সকলেই স্থানীয় লোক  । বাস বেশ ভালোই চলছিল, মাঝে মাঝে দুয়েক জায়গায় লোকজনের ওঠানামা । কিন্তু বিধি বাম । যান্ত্রিক গোলযোগে বাস সিংতামে এসেই দাঁড়িয়ে গেল ।





মেঘলা গোধূলিবেলা, ধীরে ধীরে নিঝুম কালো অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ছোট্ট জনপদ ।ছোট্ট শহর সিংতাম, দোকানপাট এরমধ্যেই বন্ধ হতে শুরু করেছে । তবে পাহাড়ি শহর হলেও একটু গুমোটে ভাব । বাড়ি ঘরের জানালা দিয়ে পাখাও চলতে দেখা যাচ্ছে । রাস্তায় জনমানুষ তেমন নেই । এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাকল, " ও গ্যাংটক যানেওয়ালে ভাইসাব " । এমন সম্বোধনে হকচকিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক । পেছনে তাকিয়ে সৌম্য দেখল বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারার একজন স্থানীয় মানুষ । দুহাতে দুটো টিনে সম্ভবত রান্নার তেল । আর কাঁধে এক ঝোলায় খুব সম্ভবত নানা রকমের মশলাপাতি । রাস্তার টিমটিমে আলোয় মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, তবে মুখে যে একটা মিষ্টি হাসি আছে - সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে । থাকেন রাবংলা, সৌম্যর সাথে ওই বাসেই ছিলেন। সিংতামে এসে বাস পাল্টে তিনি বাড়ি ফিরবেন । ইতিমধ্যেই একটা জিপ ভাড়া করেছেন, সেই গাড়িতে যদি আজ রাতেই রাবংলা যাওয়া যায়, তাহলে গাড়িভাড়াটা শেয়ার করে যাওয়া যেতে পারে । উত্তম প্রস্তাব , নামী কোম্পানির টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার সৌম্য, বছর ছাব্বিশের অবিবাহিত যুবক, চাকরি সুত্রে শিলিগুড়ি আসা, পিছুটান নেই, তাই কোথাও একটা গেলেই হল। গ্যাংটকে তো বহুবার যাওয়া হয়েছে । রাবংলার দিকটায় যাওয়া হয়নি । 




পাহাড়ের পথে জিপ চলতে শুরু করল, শহর ছাড়িয়ে একটু এগোতেই একরাশ নিকশ কালো অন্ধকারের গ্রাসে ঢেকে গেল চারিদিক, গাড়ির জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না, গাড়ির ভেতরেও আরও জমাট অন্ধকার। হেডলাইটের আলোয় শুধু সামনের দিকের রাস্তাটুকু দেখা যাচ্ছে । গাড়ি যে কোন পথে কোথায় যাচ্ছে, তা ঠাওর করা যাচ্ছে না । ভেতরে কিন্তু আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। লোকটির নাম পাষাং , রাবংলাতে একটি হোম স্টে চালান। বেশ আমুদে ভদ্রলোক, নানান মজার সব কথা বলতে লাগলেন। বাড়িতে স্ত্রী আছেন, আজকে বিবাহবার্ষিকী । তাই বিশেষ উপহার নিয়ে যাচ্ছেন স্ত্রীর জন্য। কথায় কথায় বিয়ার বের করলেন ঝোলা থেকে। আজ বিবাহবার্ষিকী, তাই এখন থেকেই সেলিব্রেশন। বিয়ার খেতে খেতে নানান কথা হচ্ছিল । এভাবে এক অচেনা মানুষ এত তাড়াতাড়ি এতো কাছের বন্ধু হয়ে যাবে, সৌম্যর তা ধারণা ছিল না । সৌম্য জিজ্ঞাসা করল , বিবাহবার্ষিকীতে বউ-এর জন্য কী গিফট নিয়ে যাচ্ছে পাষাং ? পাষাং বেশ রসিকতার সুরে বলল, " কেন ? এই তো তোমাকেই নিয়ে যাচ্ছি ।" ইয়ার্কিটা সৌম্যর পছন্দ হল না, তবুও হাসল ।  হাসি ঠাট্টায় কখন যে রাবংলা পৌঁছে গেল, বুঝতেই পারিনি ।যদিও শহরটা রাবংলা না অন্য কোথাও, সেটা বোঝার উপায় নেই ।  গাড়ি থামল মূল শহর থেকে আরও কিছুটা দূরে এক জায়গায়। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিঁঝিঁ পোকার অবিশ্রান্ত ডাক। বেশ ঠান্ডা লাগছে ।



মূল রাস্তা থেকে জঙ্গলে ঢাকা পথে একটু নিচে নেমে পাষাং-এর হোম স্টে । বেশ ঠান্ডা চারিদিক । আশেপাশে আর কোন বাড়ি আছে বলেও মনে হল না । ইলেক্ট্রিসিটি নেই মনে হয়, শুধু ঘরের ভেতর থেকে টিমটিমে একটা আলো দেখা যাচ্ছে । সৌম্য যতই সেই হোম স্টে-র দিকে এগোতে লাগল , ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কমে চারিদিক অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায় ডুবে যেতে লাগল , আর পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল ঠান্ডা । ঘরের লাগোয়া বারান্দায় টিমটিমে একটা কেরোসিন ল্যম্প নিয়ে পাষাং-এর স্ত্রী বেরিয়ে এলেন । পাষাং স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল, " নাও, তোমার জন্য গেস্ট এনেছি । একটু খাতির যত্ন করো ।" পাষাং আর সৌম্যকে দেখে অদ্ভুত এক লাস্যময়ী স্মিতহাস্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল পাষাং-এর স্ত্রীর মুখ । 

দু'কামরার ছোট্ট কাঠের বাড়ি । সামনের ঘরটিতে গেস্ট থাকেন, সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম । পেছনের ঘরে পাষাং-এর সংসার । তোফা বন্দোবস্ত । একটা খাট, খাটের পাশে ড্রেসিং টেবিল । ঘরে একটা টেবিল চেয়ারও রয়েছে । টর্চের আলোয় দেখে নিল সৌম্য, সারাদিন অনেক ধকল গেছে , ঝটপট ব্যগ রেখে ফ্রেশ হবার জন্য জুতো খুলতে লাগল । একটা কেরোসিন ল্যাম্প নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল পাষাং-এর স্ত্রী । এই প্রথম ভালো করে তাকে দেখতে পেল সৌম্য । বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি মারছে কেউ । এত সুন্দরী মহিলা এর আগে সৌম্য দেখেনি । মহিলাও সৌম্যর দিকে লাস্যময়ী দৃষ্টিতে চাইলেন । চোখে অদ্ভুত এক মাদকতা আছে, যে কোন পুরুষকেই বশ করার ক্ষমতা রাখে সেই দৃষ্টি , সারা শরীরে শিহরণ জাগায় । বেশ কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকে সৌম্য নিজেই লজ্জা পেল ।
লাজুক হেসে সৌম্য বলল, " Happy marriage anniversary ভাবি" । প্রত্যুত্তরে হেসে জবাব এলো, "আমার নাম তিয়াস । ফ্রেশ হয়ে নিন, পরে কথা হবে " । এই বলে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে প্রস্থান করলো তিয়াস ।

ভালো করে ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলের পাশে এসে ওপর বসল সৌম্য । একটাই টিমটিমে আলো, পুরো ঘরটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না ।  দরজা ভেজানোই ছিল । পাষাং ভেতরে এসে বললেন , একটা জরুরী কাজে তাকে কাছেই একগ্রামে তার আত্মীয়ের বাড়ি যেতে হবে । যে জিপটা করে তারা এসেছিল, সেটাতেই নাকি তিনি যাবেন । এই বলে তিনি চলে গেলেন । সবই কেমন যেন নিঝুম, কোথাও কোন শব্দ নেই । কিছুক্ষণ বসার পরই একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো সৌম্য । এই নির্জন অন্ধকারে, এরকম একটা অচেনা গ্রামে, এক ভদ্রলোক এভাবে এত রাতে চলে গেলেন, অথচ বাড়িতে একা স্ত্রী আর অচেনা একটা লোক ! কে জানে, হয়ত পাহাড়ি মানুষের সরলতা হবে । পরক্ষণেই আবার মনে দুশ্চিন্তার উদ্রেকও হল - তাকে কোন ভাবে ফাঁসানোর চক্রান্ত রচিত হচ্ছে নাতো ? অন্ধকার ঘরে ল্যাম্পের বিপরীতে নিজের ছায়া দেখে নিজেই কেমন চমকে উঠল সৌম্য । সেই ঘরে সে একা । কয়েকটা পোকা খালি উড়ে এসে ভীড় করছে ল্যাম্পের পাশে । কয়েকটা আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে অজানা এক সম্মোহনে ।  এই নিঃশব্ধতা, এই নিঃসঙ্গতা সবই অদ্ভূত লাগছে তার কাছে, সবই যেন অদৃশ্য এক নিয়তির রহস্যময় অঙ্গুলিলেহনে হচ্ছে । নাহলে চেনা জানা নেই, পাশাং এর সাথেই বা কেন যোগাযোগ হলো, কেনই বা অচেনা সে এক মানুষের সাথে তার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিল ? সম্বিৎ ফিরলো তিয়াসের ডাকে, " ক্যায়া শোচ রহে হো সাব, খানা কা লো " ।
খাবার নিয়ে তিয়াস হাজির । তিয়াসকে আরও মোহময়ী লাগছে । হাউসকোটের ভেতর রাত পোষাকের মধ্যে দেহ বিভঙ্গের রেখা স্পষ্ট , সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল সৌম্যর । খাবার বলতে রুটি আর মাংস । কিন্তু মুখে দিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো । চিকেন মাটন নয়, এমনকি পর্ক কিংবা বিফও না.. যেন অন্যকিছুর মাংস । খেতে পারল না সৌম্য । চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে দেখলো পেছনে তিয়াস তাকিয়ে আছে সৌম্যর দিকে, একদৃষ্টে । চোখে এক অজানা সম্মোহনী আহ্বান । " ক্যায়া হুয়া সাব? খানা পসন্দ নেহি হুয়া? " 
বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো সৌম্যর । কিন্তু মনে মনে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো । 
ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞাসা করলো, " পাষাং সাব কব লউটেঙ্গে ? "
তিয়াস হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলল, " ও তো চলা গ্যায়া, আজ আর ফিরবে না । আভি স্রেফ তুম আউর ম্যায় " !
তিয়াস খুব কাছে এগিয়ে এলো । এরকম পরিস্থিতির জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না সৌম্য । এসব তো নিষিদ্ধ চটি গল্পের বইতে হয় ! ভয় মিশ্রিত ভালোলাগায় মন উচাটন হয়ে উঠল । ন্যায় - অন্যায়ের দ্বন্দ্বে মন তার দিশেহারা । কিন্তু অমোঘ এক আকর্ষণে তার সারা শরীরে উন্মাদনা । তবু মনকে শান্ত করে দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখান করল তিয়াসকে । তিয়াসও কিছুটা হতাশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । তিয়াস বেরিয়ে যেতেই ঘরের দরজা বন্ধ করে লক লাগিয়ে দিল সৌম্য । খাটে শুয়ে পড়ল । কটা বাজে সেও বোঝা যাচ্ছে না । মোবাইলে চার্জ নেই । হাতে ঘড়িও নেই । বেশ ঠান্ডা লাগছে, অথচ সারা শরীর ঘেমে গেছে । ঘুম আসছে না । সুন্দরী রমণীর হাতছানি উপেক্ষা করে কজন পুরুষই বা শান্ত থাকতে পারে ? যত সময় গড়াতে লাগলো , শরীরের কামনা বাড়তে লাগলো , চিন্তায় বারবার তিয়াসকে দেখতে পেল । এভাবে কিছুক্ষণ থাকতে থাকতে তন্দ্রা এলো । 

কিছুটা ঘুমিয়ে পড়েছিল , পাশ ফিরতে গিয়ে নরম শরীরের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল সৌম্য ! ঘরের ল্যাম্পের আলো প্রায় নিভু নিভু, সেই আলোয় দেখল তিয়াস তার পাশেই শুয়ে আছে । তারদিকে তাকিয়ে সেই লাস্যময়ী হাসি , চোখে সর্বগ্রাসী কামনা ! কিভাবে এলো তিয়াস ! সৌম্যর স্পষ্ট মনে আছে, সে নিজে ঘর বন্ধ করে শুয়েছে ! তিয়াস আরও কাছে সরে এলো । পরনে তার শুধুই রাত পোশাক। তিয়াস সৌম্যর গালে হাত দিল । অস্বাভাবিক ঠান্ডা সে হাত । সৌম্য উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু একটা যেন তাকে আটকে রেখেছে । তিয়াস সৌম্যর শরীরের ওপর চেপে বসেছে । সৌম্য চেষ্টা করলেও কিছুই করতে পারছে না । সে যেন তার সমস্ত শক্তি হারিয়েছে । যেন ময়াল সাপ তাকে জড়িয়ে ধরেছে । তিয়াসের ঠোঁট তার সারা মুখের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে । হঠাত খুব জোরে হেসে উঠল তিয়াস । তার এলোচুল ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখের ওপর । মুখটা অদ্ভুত সাদা , আর চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল । তিয়াস ঝুঁকে পড়ে সৌম্যর মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে এলো । হিসহিসে গলায় বলল, " আব মেরী পিয়াস বুঝাও সাব "। এই বলে সজোরে কামড়ে ধরল সৌম্যর গলা । সৌম্যর শরীরের রক্ত শুষে চলেছে তিয়াস । সৌম্যর জ্ঞান আছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছে না । যত সময় যাচ্ছে, এক শীতলতার দিকে ঢলে পড়ছে , মৃত্যুর পথে ঢলে পড়ছে সৌম্য । তবু মরার আগে শেষ চেষ্টা করল । খাটের পাশে ড্রেসিংটেবিলের ওপর তার ছুড়িটা ছিল । সৌখিন হলেও কাজের, ছুড়ির হাতলে তিব্বতী মন্ত্র খোদাই করা । সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়িটা হাতে নিয়ে চালাল তিয়াসের গলা লক্ষ্য করে । হকচকিয়ে গিয়ে তিয়াস সৌম্যকে ছেড়ে খাট থেকে নেমে পড়ে । সৌম্য টর্চের জোরালো আলো ফেলে তিয়াসের মুখে । তিয়াস হঠাত মিলিয়ে যায় , যাওয়ার খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে আগে বলে যায়," ফির মিলেঙ্গে সাব , অব তো তুম হাম জ্যায়সা বন গয়ে হো "। সৌম্য অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলো  ।


সৌম্যকে পরদিন উদ্ধার করা হয় রাস্তার ধারের জঙ্গল থেকে । সৌম্যর অচৈতন্য দেহের আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর পাওয়া যায়নি । পাষাং নামের কোন ব্যক্তি বা হোম স্টেও ছিল না সেখানে । গলার গভীর ক্ষত থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল সৌম্যর । হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর সৌম্য যা বলেছিল , তা কেউ বিশ্বাস করেনি ।  এরপর থেকে সৌম্যর আচরণে , খাদ্যাভ্যাসে বেশ পরিবর্তন এসেছিল । কিছুদিন পর সৌম্য রাবংলার উদ্দেশে আবার রওনা হয় । এরপর আর কোনোদিনও সৌম্যকে খুঁজে পাওয়া যায়নি ।  


Sunday, 10 March 2019

নিশিযাত্রী

মিশমিশে কালো অন্ধকার ভেদ করে পিচকালো রাস্তা দুধারের বিশাল বিশাল গাছের হেলে পড়া ডালের সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে । হেডলাইটের আলো যতটা দূরত্বে গাছের গায়ে ধাক্কা লেগে আলোকিত হচ্ছে, ততটুকুই যেন জগত, এছাড়া বিশ্বসংসারে আর কোথাও কিছুর অস্তিত্ব নেই । বেশ কয়েকবছর আগের কথা, শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা ফিরছি , রাত প্রায় দেড়টা, নির্মীয়মাণ জাতীয়সড়ক এনএইচ ৩৪ তখনও ভারী ট্রাক চলায় ধুলোর আস্তরণে প্রায় কুয়াশাচ্ছন্ন । সামনের একটা বাইকে দুই ভাতৃপ্রতিম বন্ধু , আমার দীর্ঘদিনের রাইডিং পার্টনার । ওই বাইকে জোরালো এইচআইডি লাইট লাগানো, পেছনে আমি আমার বাইকে একা । এভাবে চলতে চলতে কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না, দুর্গোৎসবের শেষে দ্বাদশীর চাঁদও ক্লান্ত হয়ে অস্তাচলগামী। রাস্তাঘাট শুনশান, শুধু মাঝে মধ্যে কয়েকটা শেয়াল দৌড়ে রাস্তার এপার ওপার করছে । আর মাঝে মধ্যে মানুষের আনাগোনা, রাস্তা পারাপার । তবে হেডলাইটের আলোয়, আর বাইকের গতিতে মানুষের অবয়বগুলিই বোঝা যাচ্ছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না । গ্রামের মানুষ হবে হয়ত, অথবা চোর ছ্যাঁচড় । খেয়াল করলাম, শরতের রাতে হালকা ঠান্ডায় সবাই চাদর পড়ে আছে । এখানে থামার কোন প্রশ্নই নেই, বাইকের গতি একটু বাড়ালাম । কিন্তু সেই অবয়বগুলোর আনাগোনা যেন বেড়ে গেল । আর তাদের রাস্তা পার হওয়াটাও যেন বিচিত্র , পায়ে যেন চাকা লাগানো, নিয়ন্ত্রিত গতিতে ভ্রূক্ষেপহীন হয়ে রাস্তা পার হচ্ছে ।


বাইক চালালে একজন বাইকারকে সামনে ও পেছনে একইসাথে নজর রেখে চলতে হয়, পর্যায়ক্রমে সামনের দিকে আর পেছনের আয়নায় ক্রমাগত লক্ষ্য রাখতে হয় আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস পেতে । এটা অভ্যাসে পরিণত করতে হয় । আমিও সেভাবেই তাকাচ্ছিলাম । কিন্তু মনে কেমন যেন অস্থিরতার উন্মেষ ঘটল, ভাস্করের বাইক অনেকক্ষণ ধরেই দেখতে পাচ্ছি না , অথচ শুনশান রাস্তায় আমি তখন যেন একা নই । আমার পাশে পাশে যেন কেউ চলছে । রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম একাধিক বাইকের আলো । তিন চারটে বাইক হঠাত কোথা থেকে এলো রে বাবা ! ডাকাত নয়তো ? বেশ চিন্তায় পড়লাম, কিন্তু বাইক গুলো আমাকে ওভারটেক করছে না । ভাবলুম স্থানীয় মানুষ হবে , একটু ভালো করে দেখব বলে পেছনে তাকাতেই প্রথম চমকটা পেলাম । কেউ কোথাও নেই, সঙ্গে সঙ্গে আবার রেয়ার ভিউ মিররে তাকালাম । নাহ ! আশ্চর্য , পেছনের বাইকগুলো কোথায় গেল কে জানে ? কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার বাইকের আলো দেখা গেল , আবার যথারীতি পেছনে তাকাতে দেখলাম কেউ নেই । অথচ , বেশ মনে হচ্ছে যেন আমার পাশে পাশে আরও কয়েকটা বাইক চলছে । এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর আবার রেয়ার ভিউ মিররে আলোগুলো দেখলাম । আর সাথে সাথে একটা লরির হর্ন বাজল । রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম জোরাল আলো, একটা লরি পেছন থেকে বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে আসছে । তার সামনে ওই বাইকগুলো, আর আমি তাদের থেকে একটু এগিয়ে । পেছনে তাকাবার সময় নেই, লরিটা কাছাকাছি এসে পড়েছে । ঠিক করলাম,  এসময় সামনের কোন escape খুঁজে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লরির গতিবেগের ওপর নজর রাখব । বাকিটা ঈশ্বরের ইচ্ছে । এমন সময় দেখলাম বাইকগুলো আমাকে ওভারটেক করে অসম্ভব জোরে এগিয়ে গেল , রাস্তাটা ডানদিকে মোড় নিয়েছে , পেছনে লরি , এই সুযোগ, আমি রাস্তা ছেড়ে নিচে নেমে গেলাম । লরিটা একদম গা ঘেঁসে যেন বাইকগুলোকে তাড়া করতে করতে চলে গেল । পথের ধারের সুরকি পথে চাকা একটু স্কিড করল , টাল সামলে বাইক থামালাম ।



বাইক থামতে যেন অন্য জগতে ফিরে এলাম । লরির শব্দ শোনা যাচ্ছে না, বদলে শুধুই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক । নিশুতিরাত, জনমানব শূন্য রাস্তা, চাঁদটা আরও ঢলে পড়েছে । সামনে বন্ধুর বাইকও দেখা যাচ্ছে না । ফোনের চার্জও শেষ অনেকক্ষণ । তাই দেরী না করে আবার এগোতে থাকলাম । রাস্তাটা ডানদিকে ঘুরেছে, একটু এগিয়েই হেডলাইটের আলোয় আরও কিছু লোকজন, আমাকে দেখেই দ্রুত এগিয়ে এলো । বাইকের গতি কমাতেই এরমধ্যে একজন বললেন, “ দাদা, একটু এগিয়ে দিন, সামনেই একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে ।” এই বলেই আমার পেছনের সিটে বসে পড়লেন । বেশ ভয় লাগছিল, ডাকাতের পাল্লায় পড়লাম না তো ?! তবুও, উপায় নেই । কিছুটা এগিয়েই বাইকটা থামাতে বললেন ভদ্রলোক । সামনে রাস্তার ধারে একটা কিছু ঘিরে আরও কিছু লোকের জটলা ।


লোকটি আমার বাইকের পেছন থেকে নেমে গেলেন । আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন মনে হয়, আমার কানে কিছুই ঢুকল না, আমি পাশ কাটিয়ে গতি বাড়ালাম । কিছুটা যেতেই সামনে পেছনে আবার সেই নিকশ কালো অন্ধকার । বেশ দিশেহারা মনে হচ্ছিল নিজেকে । এমন সময় রেয়ার ভিউ মিররে দেখলাম পেছনে হঠাত আলোর ঝলকানির মত সাদা HID লাইট। ভাস্করের বাইক না ? গতি কমাতেই সত্যি সত্যিই ভাস্কর আর অয়ন এসে পড়ল । “ কি গো জয়দীপদা ? হঠাত স্পিড বাড়িয়ে এগিয়ে গেলে কেন ?! ”

“ আসলে, অন্ধকারে মনে হয় একটু তন্দ্রা এসেছিল, খেয়াল করিনি । আচ্ছা, তোদের কি কোন লরি ওভারটেক করেছিল একটু আগে ? রাস্তায় কোন গোলমাল দেখলি ? ”

“ কৈ ? নাতো ? তুমি ঠিক আছো তো ? ”

“ দিব্য আছি । বেঁচে আছি । অয়ন, তুই বাকি রাস্তা আমার বাইকটা চালা , আমি পেছনের সিটে বসছি, লাগেজটা ভাস্কির বাইকের পেছনে বেঁধে দে । ”

চাঁদটা তখন পশ্চিমে অস্তগামী । সহযাত্রীর সাথে আবার একত্র হতে পেরে বেশ রিল্যাক্সড লাগছে । এখানে রাস্তাটা বেশ খোলামেলা , ওইরকম গাছের সুড়ঙ্গ নেই ।  আমার যুক্তিবাদী মন বলছে , “ অল ইজ ওয়েল । হয়ত ঘুমের ঘোরে হ্যালুসিনেশান হয়েছে । হয়ত আমি অন্য কোন ঘুরপথে ঢুকে পড়েছিলাম যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে, যেটায় ভাস্করেরা যায়নি । রাস্তাটা আবার একজায়গায় মিশেছে , তাই দেখা হয়ে গেছে । শুধু একটাই হিসাব মিলল না । আমার পেছনের সিটে আমার লাগেজ বাঁধা ছিল, সেখানে কোন মানুষের পক্ষেই বসা সম্ভব নয় ।
( ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত )

Sunday, 1 February 2015

Dao hill

ভুতুড়ে শহর কারশিয়াং  :-
====================
পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে নানান সব অদ্ভুত কাহিনী । এর কোনওটা সত্যি কোনও টা আবার অবিশ্বাস্য , যুক্তিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না । তেমনই একটা জায়গা হল কারশিয়াং । পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় এই হিল স্টেশনটার সাথে জড়িয়ে আছে নানান ভুতুড়ে কাহিনী । এই শহরটি বেশ পুরনো , এর আনাচে কানাচে রয়েছে বহু পুরনো বাড়ি, আর আছে জঙ্গল । এই শহরের Dow Hill অঞ্চলটিকে ভারতের অন্যতম ভুতুড়ে অঞ্চল বলা হয়ে থাকে ।



Dow hill এ আছে Victoria Boys School , যা কিনা ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো । একে ঘিরে কথিত আছে বেশ কিছু রোমহর্ষক কাহিনী । স্কুল ছুটি থাকাকালীন ফাঁকা স্কুল বাড়িটিতে অনেকেই নাকি দেখেছেন, যে, কোনও এক ছাত্র নাকি এই বাড়ির কোনও এক জানালায় বসে আছে, এছাড়াও অনেক রাত্রে ছেলেদের খেলাধুলা করার আওয়াজও নাকি ভেসে আসে এখান থেকে । যদিও আজ পর্যন্ত এই স্কুলের কোনও ছাত্র এরকম কোনও ভুত দেখেননি । তবে স্থানীয় লোকজন স্কুল বন্ধ থাকাকালীন এমন অতি প্রাকিতিক ঘটনাগুলি উপলব্ধি করেছেন বলে শোনা যায় ।

Dow hill এর জঙ্গল নাকি আরও ভয়ঙ্কর । এখানে একা একা পথ চলতে গিয়ে অনেকেই নাকি দেখেছেন কোনও এক মস্তকহীন ছাত্র নাকি তাঁকে অনুসরণ করে আসছেন । অনেক সময় একাধিক ছেলেকেও দেখা যায় । মাঝে মাঝে দেখা যায় , কোনও লাল চোখ যেন Dow Hill এর ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলের ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে ।

যিনি একবার দেখেন সেই দৃশ্য, সারাজীবন নাকি সেই স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় তাকে, এরকম অনেকে নাকি শেষ পর্যন্ত সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যাও করেছেন । এই Dow hill -এ কাঠ কাটতে গিয়ে অনেকে নাকি আবার কোনও মহিলার ভয়ার্ত আর্তনাদও শুনেছেন । এই সমস্ত ঘটনাবলী কাকতালীয় মনে হলেও বহুদিন ধরে এখানকার মানুষজনের মধ্যে প্রচলিত । যদিও সরকারি ভাবে এই ধরনের কোনও তথ্য সংরক্ষিত নেই।
                      বন্ধুরা, এসব কথার সত্যতা যদি যাচাই করতে হয়, তাহলে কোনও এক অমাবস্যার রাতে একা একা চলে যেতে পারেন Dow hill , Kurseong. ফিরে এসে আপনার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে ভুলবেন না যেন ।
   
N.B : ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ।